Oct 20, 2012

She is my sister

 ফোনটা বাজছে। বাড়ি থেকে ফোন। আমি নিশ্চিত, ফোনটা আমার ছোট বোনই করেছে। কদিন ধরেই ওর লুকিয়ে মায়ের মুঠোফোন থেকে ফোন করার মাত্রাটা বেড়ে গেছে। ফোন করে সেই এক জিজ্ঞাসা, ‘ভাইয়া, টাকা পাইছ?’ কাঁপা কণ্ঠে প্রতিবারই উত্তর দিয়েছি, এখনো পাইনি, তবে চিন্তা করিস না, ঈদের আগেই পেয়ে যাব। রেজাল্টটা হলেই বৃত্তির টাকাটা তুলতে পারব। আজও নিশ্চয়ই সেই একই কথা জিজ্ঞেস করবে। মেজাজটা এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে। জানতে পেরেছি, কোনো কারণে ঈদের আগে রেজাল্ট হচ্ছে না। সুতরাং, টাকাটাও পাচ্ছি না। কী করব বুঝতে পারছি না। ছোট বোনকে কথা দিয়েছিলাম, যে করেই হোক সামনের ঈদে আমরা খাসি কোরবানি দেব। ও গরুর মাংস খায় না বলে সেবার ঈদের দিন আমরা আশায় ছিলাম, কেউ না কেউ হয়তো খাসির মাংস আমাদের দেবেই। কিন্তু কেউ দেয়নি। আমার কিংবা আমার মায়েরও সাধ্য ছিল না তাকে বাজার থেকে মাংস কিনে খাওয়ানোর। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। পরদিন সকালে কথা দিয়েছিলাম, দেখিস, সামনের ঈদে আমরা খাসি জবাই করব, দেখব কত মাংস খেতে পারিস। শুনে ও হেসে বলেছিল, ‘সত্যি তো, না হলে কিন্তু তোমার সঙ্গে কথা বলব না।’ হবে মানে অবশ্যই হবে—বুক ফুলিয়ে তখন জবাব দিয়েছিলাম। সেই থেকে ওর দিন গণনা শুরু, প্রতিবার বাড়িতে গেলেই এক জিজ্ঞাসা। মা বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বলতেন, ‘দুই বেলা খেতে পারি না, আবার কত শখ!’ আমি মাকে আশা দিয়ে বলেছি, না, মা এবার সত্যিই আমরা কোরবানি দেব। উত্তরে মা কিছু বলেননি। মা হয়তো বুঝেছিলেন, ছোট বোনকে আমি মিথ্যা আশা দিচ্ছি। কিন্তু ক্রমাগত আমার একগুঁয়েমিতে মাও একসময় আশান্বিত হয়ে বললেন, ‘বাবা সত্যিই কি তুই পারবি?’ জোর দিয়ে বলেছি—অবশ্যই। ‘তাইলে তো ভালোই হয় রে বাবা, তোর আব্বা মারা যাওয়ার পর কত বছর পার হইল আমরা কোরবানি দিই না।’ ফোনটা রিসিভ করলাম। জোরে একটা ধমক দিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। আব্বাকে আমার মনে নেই। কালেভদ্রে যেখানে বছরে দু-একবার মাংস খেতে পারতাম, সেখানে কোরবানি দেওয়ার চিন্তা ছিল আমাদের মহা স্বপ্ন। পাশের বাড়ির চাচাদের কোরবানি মানেই আমাদের কোরবানি। মনে পড়ে, চাচার সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে আমিও তাদের গরুর সঙ্গে কোরবানির মাঠে যেতাম। চামড়া ছাড়াতে গরুর পা ধরে সাহায্য করতাম। আমার মা তাদের মাংস কেটে, পরিষ্কার করে দিয়ে পুঁটলিতে সামান্য মাংস নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম, কখন সেটা রান্না হবে। আমি যেভাবে চিন্তা করেছি, আমার ছোট বোন হয়তো সেভাবে পারেনি। যা-ই হোক, অনেক কষ্ট করে পাঁচ হাজার টাকা জোগাড় করলাম। মনে মনে শান্তি পেলাম ছোট বোনকে দেওয়া কথাটা রাখতে পারব বলে। সব গুছিয়ে রাতের ট্রেনে উঠে বসলাম। নিরাপত্তার জন্য টাকাটা পকেটে না রেখে ব্যাগে রেখেছিলাম। সারা দিনের ক্লান্তি আর ট্রেনের ঝাঁকুনিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, টের পাইনি। ঘুম ভাঙলে দেখি, কোলের ওপর রাখা ব্যাগটি নেই। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ক্লান্ত দেহটাকে কোনো রকমে টানতে টানতে বাড়ি ফিরলাম। যেতেই বোন ছুটে এসে জাপটে ধরে বলল, ‘ভাইয়া, আমরা কোরবানি দেব তো।’ বোনের হাত ছাড়িয়ে ঘরে গিয়ে বসে রইলাম চুপচাপ। পরের দিন মাকে সব খুলে বললাম। বললাম, বোনকে কিছু না বলতে। কিন্তু আড়াল থেকে ও সব শুনে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। মা গিয়ে ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। চড় খেয়ে ও কোথায় যেন পালিয়ে গেল। সেবারও আমার বোন ঈদে মাংস খায়নি। কিন্তু এবার আর বোন তোকে না খেয়ে থাকতে হবে না। এবার আমি টাকা জমিয়েছি, আর আমি ট্রেনে ঘুমাব না, দরকার হলে ওর জন্য সারা রাত জেগে থাকব।
আকরাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Reference: Poignant article from Prothom-alo

No comments:

Cat

Ragdoll Cat         Persian Cat     Finish Cat